36 C
Dhaka
Thursday, April 25, 2024

কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট: প্রযুক্তির মহাকাশ দখলের সূচনা যেভাবে!

How technology began to occupy space!

- Advertisement -

স্যাটেলাইট বা উপগ্রহকে খুবই সহজে সংজ্ঞায়িত করলে বলা যায়, স্যাটেলাইট মহাকাশে অবস্থিত এমন একটি বস্তু, যা এরচাইতে তুলনামূলক অনেক বড় একটি বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘোরে। স্যাটেলাইট দুই প্রকৃতির হয়ে থাকে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম। আমাদের কাছে প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ যেমন চাঁদ, তেমনই কৃত্রিম স্যাটেলাইটের উদাহরণ হতে পারে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১।

- Advertisement -

সাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে, আর সে সময়টা সাটেলাইট ছিল অনেকটা আজকের দিনের মঙ্গলে বসবাসের স্বপ্নের মত। গনিতবিদ আর্থার চার্লস ক্লার্ক ছিলেন তখনকার অন্যতম একজন সাইন্স ফিকশন লেখক, তিনি সেসময়কার ব্রিটিশ ইন্টারপ্ল্যানেটারি সোসাইটির সদস্যও ছিলেন। ১৯৪৫ সালে গনিতবিদ আর্থার চার্লস ক্লার্ক ওয়ারলেস ওয়ার্ল্ড নামক একটি ম্যাগাজিনে কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহার করে টেলিভিশন প্রোগ্রাম সম্প্রচার করার ধারণা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেন। মহাকাশ অন্বেষণ গবেষণার প্রারম্ভিক সেই যুগে তার লেখাটি সেইসময়কার বিজ্ঞানিদের মনে বেশ সারা ফেলেছিল, আর বলা হয় তার সেই প্রবন্ধ তথা আর্টিকেল থেকেই সাটেলাইট ব্রডকাস্টিং এর প্রথম ধারনা এসেছিল। এরপর প্রায় ১দশক পরে এই ধারনাকে আরও বাস্তবভাবে এবং সম্ভাবনার দিকগুলির সাথে উপস্থাপন করেছিলেন বেল ল্যাব এর ইঞ্জিনিয়ার জন রবিনসন পিয়ার্স।

১৯৫৪ সাল,বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যে একটা বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হবে তা তখনও কারো মাথাতে তেমন আসেনি। না আসাটাই স্বাভাবিক, মহাকাশে তখনও প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক ১ প্রেরন করাই হইনি। স্যাটেলাইট গবেষণার চুম্বককালে সবার সামনে এসেছিলেন তৎকালীন আমেরিকার এটি-এন্ড-টি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির অধীন ‘বেল ল্যাবরেটরিজ’ এর অন্যতম একজন ইঞ্জিনিয়ার জন রবিনসন পিয়ার্স। জনাব পিয়ার্স যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট ব্যবহারের পেছনে প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতার এবং সাটেলাইটের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিকগুলো খুব ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে সে বছর একটি বক্তব্য দেন, পরবর্তী বছর এর অপর একটি প্রবন্ধও লিখেন।

- Advertisement -

ট্রান্স-আটলান্টিক টেলিফোন কেবল সিস্টেম ( ট্যাট-১) ছিল পৃথিবীর প্রথম সাবমেরিন টেলিফোন ক্যাবল নেটওয়ার্ক। সেইসময় ট্রান্স-আটলান্টিক টেলিফোন কেবল যোগাযোগ ব্যাবস্থায় একযোগে ৩৬টি টেলিফোন কল করা যেত। যেখানে বছরে গড়ে খরচ আসতো অর্ধশত মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি! ইঞ্জিনিয়ার পিয়ার্স কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের যে ধারনা দিয়েছিলেন তাতে একযোগে ১০০০টি পর্যন্ত টেলিফোন কল করা যেত। তিনি এর মাধ্যমে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি দিয়ে সেসময় বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনার পথ দেখান।

স্পুটনিক ১। ছবির সোর্সঃ উইকিপিডিয়া

সোভিয়েতদের কারনে মহাকাশ গবেষণায় আমেরিকা ও ইউরোপিয়ানদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছিল। তবে ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর স্পুটনিক ১ সফলভাবে মহাকাশে প্রেরন যেন তাদের সেই আগ্রহকে আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর আমেরিকা এবং ইউরোপের ভেতর স্যাটেলাইট নিয়ে খুব জোরে-সরে কাজ শুরু হয়। এবার ঠেকায় কে? কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যে ব্যাপক বাণিজ্যিক লাভ এবং বিশ্বে তাদের এক প্রতিপত্বি বিস্তৃতি করা সম্ভব আমেরিকা সেটি বুঝে গিয়েছিলো।

- Advertisement -
টেলস্টার ১। ছবির সোর্সঃ উইকিপিডিয়া

তৎকালীন বেল ল্যাবরেটরিজ টেলস্টার ১ নামক প্রথম (লো আর্থ অরবিট) কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট তৈরি করে। উৎক্ষেপণের সময় যার ভর ছিল ১৭১ কিলোগ্রাম। নাসা এই টেলস্টার-১ স্যাটেলাইট ১৯৬২ সালের ১০ই জুলাই পৃথিবী কক্ষপথে প্রেরন করে। টেলস্টার-১ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গণিতবিদ সার আর্থার চার্লস ক্লার্ক এর স্বপ্ন যেন বাস্তবে পরিণত হয়! কেননা টেলস্টার ১ স্যাটেলাইট দিয়ে মানুষ প্রথম স্যাটেলাইট টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং এর সাক্ষী হয়েছিল।

টেলস্টার উৎক্ষেপণের আগে যুক্তরাষ্ট্র আর্মি সোভিয়েন ইউনিয়নের সাথে হালকা টেক্কা দেবার জন্য , পৃথিবীর প্রথম সলার প্যানেল এবং ব্যাটারি রিচার্জ ক্ষমতা সম্পন্ন ‘এক্টিভ রিপিটার কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট ‘কুরিয়ার ১বি’ প্রেরন করেছিলো।

নাসা টেলস্টার মহাকাশে উৎক্ষেপণ করলেও , এই টেলস্টার স্যাটেলাইটটির মালিক ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ বেল ল্যাব্রেটরিজ। তাই যুক্তরাষ্ট্র এবার সিদ্ধান্ত নিলো তারা একাই সাটেলাইট পাঠাবে, এবং ইউরোপীয়দের সহযোগিতা নিবে না। তাই ‘টেলস্টার ১ এবং ২’ এরপরে নাসা নিজেদের অর্থায়নে রেডিও কর্পোরেশন অফ আমেরিকা তথা আরসিএ এর তৈরি করা রিলে স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরন করে। এটা ছিল আমেরিকার এককভাবে তৈরি করা প্রথম পরীক্ষামূলক লো-আর্থ-অরবিট কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট।

রিলে স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে আমেরিকা প্রথম নিজেদের টেলিভিশন প্রোগ্রাম সম্প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিলো। রিলে দৌড় প্রতিযোগিতায় একজন দৌড়বিদ দৌড়ে তার দলের পরবর্তী দৌড়বিদের কাছে গিয়ে যখন তার হাতের ছোটো কাঠি তাকে দেয়, ঠিক তখন তার দলের সেই দৌড়বিদ তার স্থান থেকে দৌড়ানো শুরু করে। রিলে স্যাটেলাইটও ঠিক এইভাবেই কাজ করে। পরপর কয়েকটি রিলে স্যাটেলাইট নির্দিষ্ট দূরত্বের অরবিটে বসানো থাকে। রিলে স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন এবং রিসিভ এন্টেনা এর মাঝে এভাবে তথ্য আদান প্রদান করে।

সিনকম ২। ছবির সোর্সঃ উইকিপিডিয়া

নাসা এবার পুরোদমে মাঠে নেমে পরে, এবার তারা হুগস স্পেস এন্ড কমিউনিকেশন এর তৈরি করা সিনকম ১ স্যাটেলাইটটি মহাকাশে প্রেরণ করে (হুগস স্পেসকে ২০০০ সালে বোইং কিনে নেবার পর পরবর্তীতে এর নাম হয়ে যায়, ‘বোইং স্যাটেলাইট ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’)। আর এই সিনকম ১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করার মাধ্যমে নাসা প্রথম জিওসিঙ্ক্রনাস অরবিট অর্জনের চেষ্টা করে। তবে সিনকম ১ এ পুরোপুরি ভাবে সফল হতে না পারলেও, নাসা ১৯৬৩ সালে সিনকম ২ প্রেরণ এর মাধ্যমে সফলভাবে জিওসিঙ্ক্রনাস অরবিট অর্জন করতে সক্ষম হয়। এরপরে ১৯৬৪ সালে নাসা ‘সিনকম ৩’ প্রেরণ করে যা ছিল সকল দিক দিয়ে একটি পরিপূর্ণ জিওষ্টেশনারী স্যাটেলাইট। সে কারনে ‘সিনকম ৩’ পৃথিবীর প্রথম জিওষ্টেশনারী স্যাটেলাইট। জিও ষ্টেশনারী স্যাটেলাইট মানে, যেখানে স্যাটেলাইটটি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময়েই পৃথিবীকেই একবার প্রদক্ষিণ করবে, যার ফলে পৃথিবী থেকে সেই স্যাটেলাইটটিকে দেখলে স্থির মনে হবে, মনে হবে সেটি সেই স্থির স্থানেই অবস্থান করছে।

ইন্টেলস্যট ১। ছবির সোর্সঃ উইকিপিডিয়া

পৃথিবীর প্রথম জিওষ্টেশনারী কমার্শিয়াল স্যাটেলাইট ছিল ইন্টেলস্যাট ১, একে ১৯৬৫ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিলো। তৎকালীন ‘হুগস স্পেস এন্ড কমিউনিকেশন’ আমেরিকার ‘কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটস কর্পোরেশন’ তথা কমস্যাট এর জন্য এই কমার্শিয়াল স্যাটেলাইটটি তৈরি করে, এটিই ছিল স্যাটেলাইট কেন্দ্রিক বৈশ্বিক বাণিজ্যের সূচনা। ইন্টেলস্যাট ১ একসাথে ২৪০টি টেলিফোন সংযোগ নিয়ন্ত্রন করতে পারত, সেই সময় এটিই অনেক ছিল। আর সেসময় এই স্যাটেলাইট ব্যবহার করে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের মাসে একটি টেলিফোন সংযোগ ব্যবহার করবার জন্য ৪২০০ ডলার করে দিতে হত! টেলিফোন সংযোগ নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি ‘ইন্টেলস্যাট ১’ টেলিভিশন প্রোগ্রামও সম্প্রচার করত পারত। ১৯৬৫ সালেরই ডিসেম্বর মাসে নাসার ‘জেমিনি ৬’ নামক একটি ক্যারিয়ার স্যটেলাইট কয়েকজন মহাকাশ আরোহী নিয়ে পৃথিবী পরিভ্রমণ করে ফিরে আসে; তখন সেই মহাকাশযানের সমুদ্রে অবতরণের লাইভ টেলিকাস্ট ‘ইন্টেলস্যাট ১’ এর মাধ্যমে দেখানো হয়।

১৯৭২ সালে দেশের ভেতর অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সম্পাদন করার জন্য প্রথম স্যাটেলাইট ব্যবহার শুরু হয়, আর দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সম্পাদনের জন্য ‘অনিক ১’ নামক এই স্যাটেলাইটটি প্রেরণ করে কানাডা। আমেরিকার ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল লঞ্চিং প্যাড থেকে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হয়। এর পরেই ১৯৭৩ এবং ১৯৭৬ সালে কানাডা ‘অনিক ২’ এবং ‘অনিক ৩’ স্যাটেলাইট প্রেরণ করে। প্রশ্ন আসতেই পারে, তিনটি স্যাটেলাইট কেনো? তিনটি স্যাটেলাইট কারন যেন যোগাযোগ এর ক্ষেত্রে কোন বাধা সৃষ্টি না হয়, আর কমিউনিকেশন ফেইলিয়ার যেন না হয়, সে জন্য যেন সবসময় অন্তত একটি স্যাটেলাইট ব্যাকআপ হিসেবে থাকে। আর সেসময় কানাডা একই সাথে পরপর তিনটি স্যাটেলাইট বানিয়েছিল, কেননা একই সাথে বানালে খরচও কম পরে। আমেরিকা আন্তর্জাতিক ভাবে যোগাযোগ শুরু করার জন্য স্যাটেলাইট ব্যবহার শুরু করলেও; কানাডা প্রথম দেশ যারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সাধনের জন্য স্যাটেলাইট ব্যবহার শুরু করে।

এভাবে পরবর্তীতে পৃথিবীর বহু দেশ বাণিজ্যিক কাজে এই ব্যাপক স্পেস মিশনে অংশ নিতে শুরু করে। বর্তমানে পৃথিবীর ৭৫ টি দেশের মহাকাশে এক বা একাধিক স্যাটেলাইট রয়েছে। আর স্যাটেলাইট বাণিজ্য থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণায় আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাফল্য সত্যিই ঈর্ষনীয়। ভারতের নিজস্ব স্যাটেলাইট তৈরির পাশাপাশি তাদের নিজস্বভাবে স্যাটেলাইট পাঠানোর সক্ষমতাও রয়েছে। পৃথিবীতে কেবল ১০টি দেশ নিজস্ব ভাবে মহাকাশ যানের মাধ্যমে মহাকাশের কক্ষপথে স্যাটেলাইট স্থাপন করার সক্ষমতা রাখে, বাকিরা স্যাটেলাইট তৈরি করে এইকটি দেশের মাধ্যমে তা মহাকাশে পাঠাতে পারে।

Featured Image by Pixabay via Pexels

 

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here